অগ্নিকাণ্ডের দোকানের সব মালামাল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে হতাশা নিয়েই ২০০০ সালে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন জেলার শাহরাস্তি উপজেলার চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নের খেড়িহর গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ির মৃত ক্বারী বশির উল্লাহর ছেলে নূর মোহাম্মদ (৫৬)।
ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। কেটে যায় বেশ কিছুদিন। জীবিকার ও বাঁচার জন্য কিছু একটাতো করতে হবে। এই ভেবে প্রথমে বাড়ির পাশে ছোট পরিসরে পরীক্ষামূলক মৎস্য খামার গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি খালি ও পতিত জমিতে কয়েকটি গরু প্রতিপালন ও শাক সবজি উৎপাদনও শুরু করলেন।
সেই থেকে ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। শুরু হয় নূর মোহাম্মদের নতুন জীবন সংগ্রামের পথ।
পার্শ্ববর্তী এলাকার খামারীর উৎসাহে ও পরামর্শে মাছের খামার শুরু করেন। পরে এলাকার আশপাশের কয়েকটি হাজা মজ্জা পুকুর বর্গা নিয়ে মাছের খামারের পরিধি বড় করতে লাগলেন। এভাবে খেড়িহর গ্রামের বেশিরভাগ হাজা মজা পুকুরই বর্গা ও লিজ নিয়ে মৎস্য চাষ করতে থাকেন নুর।
দীর্ঘদিন এ পেশায় থেকে এ ব্যবসাকে কী করে আরও বড় করা যায় সে স্বপ্ন দেখতে থাকেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নে খেড়িহর গ্রামের সোনারগাঁও এলাকায় বিশাল মাঠে মৎস্য খামার গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেন। ১০০ জমির মালিকদের কাছ থেকে ১২ বছরের জন্য জমি লিজ নেন তিনি। এভাবেই ৫৫ একর (৪০ কানি) জমির লিজ নিয়ে ২০১৭ সালে বিশাল এলাকা জুড়ে এ খামারটি তৈরি করেন। এতে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় করেন তিনি।
নূর মোহাম্মদ জানান, বর্তমানে তার খামারে রুই, কাতলা, মৃগেল, আইর, শিং, মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া, পুঁটি, টেংরা, পাংগাস, ফলি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫ লক্ষাধিক মাছ রয়েছে। খামারগুলো দেখাশোনার কাজে ২০ থেকে ২৫ জন লোক নিয়োজিত রয়েছেন।
প্রতিদিন নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, লাকসাম ও দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা তার খামার থেকে মাছ কিনে নিয়ে যান।
নূর মোহাম্মদ আরও জানান, খামারে প্রতি তিন মাসে মাছের খাবারে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হয়।
তিনি জানান, এক সময় বিভিন্ন স্থান থেকে রেণু আনতেন। এগুলো আনতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতেন। পরে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে নিজের খামারেই রেণু উৎপাদন শুরু করেন।
সফল এ মৎস্য চাষী জানান, অর্থনৈতিকভাবে তিনি এখন বেশ স্বাবলম্বী। তার মাছ বিভিন্ন এলাকায় যায় । দেশের উন্নয়নে কাজ করতে পেরে আনন্দিত। তিল তিল করে এ মৎস্য খামার গড়ে তুলেছেন। এখনো দেখাশোনা করতে রাত দিন খামারের পড়ে থাকেন তিনি।
স্থানীয় কৃষিবিদদের পরামর্শে, মৎস্য খামারের চারপাশের বেড়িবাঁধের মাটি ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রজাতির ফলের চারা রোপন করেছেন। এসব গাছের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, লেবু, জলপাই, জামরুলসহ প্রায় ১৫ হাজার গাছ রয়েছে।
মৎস্য খামারের প্রবেশমুখেই তার শখের একটি গরুর খামার রয়েছ । এ খামারটিতে ৩০টি গরু রয়েছে। ১৫ লাখ টাকা ব্যয়ে শখের বসে গরুর খামারটি গড়েছেন তিনি। কোরবানির ঈদে বেশ কয়েকটা গরু বিক্রি করে লাভের মুখও দেখেছেন।
স্থানীয় সুচিপাড়া ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক আবুল কালাম, অধ্যাপিকা মাহমুদা খানম ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) মেম্বার মাহতাবউদ্দীনসহ বেশ কয়েকজন আলাপ হলে তারা নুর মোহাম্মদের খামারটি নিয়ে গর্ব করে বলেন, সে খুব পরিশ্রম ও বুদ্ধি খাটিয়ে এসব করেছে। তার কাজে ফরমালিন বা দুই নম্বরি নেই। শুধু শাহরাস্তিতে নয়, জেলায় এতো বড় পরিকল্পিত খামার দ্বিতীয়টি আছে কিনা তা জানা নেই।
নূর মোহাম্মদের বন্ধু ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যবসায়ী মো. শাহ জাহান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমিও মাছ চাষ করে আসছি। আমি মাঝে মাঝে এখানে এসে সময় কাটাই, বেশ আনন্দ পাই। নুর মোহাম্মদের সফলতায় আমিও বন্ধু হিসেবে বেশ আনন্দিত।’
প্রতিদিন খামারটি দেখতে ও প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটানোর জন্য অনেক দর্শনার্থী আসেন। খামারের চারপাশে অপরূপ সৌন্দর্য ও পাখির ডাকে দর্শনার্থীদের মন জুড়িয়ে যায়। শাহরাস্তিতে খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ানোর জন্য নূর মোহাম্মদের খামারটি এখন সকলের জন্য প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে। দর্শনার্থীদের আগমনে খামারের কিছুটা ক্ষতি হলেও তা মেনে নেন নূর মোহাম্মদ।